 |
|
Helpful Links:
|
|
| |
Shah
Wajihuddin Alvi Gujarati in Bangla
সুলউস্তাযুল উলামা হযরত শাহ্ সাইয়িদ আহ্মাদ ওয়াজীহুদ্দীন
আলাভী আল হুসাইনী গুজরাতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ- হযরত শাহ্ সাইয়িদ আহ্মাদ ওয়াজীহুদ্দীন আলাভী আল হুসাইনী
গুজরাতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ৯১০ হিজরীর ২২ই মুহাররামুল হারাম সুব্হে
সাদিকের সময় ধরার বুকে তাশরীফ আনেন। হুযুরের জন্মস্থান হিন্দুস্তানের
গুজরাত এর “মুহাম্মাদাবাদ”, যা বর্তমানে “চাঁপানীড়” নামেই লোকমুখে অধিক
পরিচিত। তিনি ছিলেন সুলতানুল আরিফীন সাইয়িদ শাহবাজ মুহাম্মাদ ভাগলপুরী
রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর মুর্শিদের মুর্শিদ। হুযুরের পিতার নাম শাহ ক্বাযী
নাসরুল্লাহ আলাভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি, যিনি চাঁপানীড় শহরের ক্বাযীর (প্রধান
বিচারপতি) পদে আসীন ছিলেন এবং দাদার নাম শাহ ইমাদুদ্দীন আলাভী রহমাতুল্লাহি
আলাইহি। হুযুরের পূর্বপুরুষগণের সকলেই ছিলেন উচ্চমানের আলিমে দ্বীন এবং
তন্মধ্যে অধিকাংশ বুযুর্গই আদালতের বিচারক, মসজিদের ঈমাম এবং শিক্ষক হিসেবে
দায়িত্ব পালন করেছেন। শাহ ওয়াজীহুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহির
পূর্বপুরুষগণের আবাসস্থল ছিল মধ্যপ্রাচ্যের ইয়ামানে, ইয়ামান এমন একটি স্থান
যার জন্য স্বয়ং আল্লাহর প্রিয় হাবীব সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি
ওয়াসাল্লাম দু’আ করেছেন, ইয়ামান থেকে শাহ ওয়াজীহুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি
এর পূর্বপরুষদের একজন হযরত শাহ বাহাউদ্দীন হুসাইনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
মক্কা শরীফ এর উদ্দেশ্যে সফর করেন, সেখানে পৌছে বাইতুল্লাহ শরীফের খিদমত ও
হাজী সাহিবানদের সেবা যত্ন ও তাদেরকে পানি পান করানোর কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
কিছুদিন পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে, এক পর্যায়ে হিন্দুস্তানের দিকে হিজরত
করার ইশারা পেয়ে হিন্দুস্তানের সফর আরম্ভ করেন এবং গুজরাতকে ঠিকানা হিসেবে
নির্বাচন করেন পরবর্তীতে তারই বংশে হুযুর শাহ ওয়াজীহুদ্দীন রহমাতুল্লাহি
আলাইহি এর জন্ম হয়। সেটি ছিল সুলতান মাহ্মুদ বেগড়ার শাসনামল। হুযুরের
মূলনাম বা পরিবার প্রদত্ত নাম ছিল “সাইয়িদ আহ্মাদ”, উপাধি ওয়াজীহুদ্দীন এবং
উপাধি ছিল “আলীয়ে সানী” অর্থাৎ “দ্বিতীয় আলী”। তিনি হানাফী মায্হাবের
অনুসারী ছিলেন। তাঁর অন্যতম কারামাত হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর আম্মাজান অজু
করতেন না, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি দুধ পান করতেন না। হুযুরের বংশলতিকা ২৭তম
পুরুষে গিয়ে মাওলায়ে কায়েনাত, আসদুল্লাহিল গালিব আমীরুল মুমিনিন সাইয়িদুনা
আলী ইবনে আবী তালিব কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু এর সাথে মিলিত হয়।
শিক্ষা জীবনঃ- ছোট্ট বয়সেই হুযুরের পরিবার চাঁপানীড় ত্যাগ করে ১৪৮
কিলোমিটার দূরে আহ্মাদাবাদে চলে আসেন। আহ্মাদাবাদ ছিল সে সময়কার জ্ঞান
বিজ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্র। এখানেই হুযুরের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ৫ বছর
বয়সে হুযুর এর শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি হয়। শৈশবেই পবিত্র কুর’আন মাজীদ এর
হিফ্য সম্পন্ন করেন। এর পরপরই হুযুরের আব্বাজান তাঁকে নিজ ভাই কাযী
শামসুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর নিকট আরবী সাহিত্য ও ব্যাকরণের কিতাব
সমূহ শিক্ষার জন্য প্রেরণ করেন। হুযুর নিজ চাচা কাযী শামসুদ্দীন
রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর নিকট আরবী ভাষার অধিকাংশ বই সম্পন্ন করেন। এর পর
মামাজান শাহ বাড়া আবুল কাসিম রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর কাছে থেকে কিছু কিতাব
এর দার্স সম্পন্ন করেন, এবং সে যুগের প্রসিদ্ধ ও অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন
মুহাদ্দিস শায়খুল মুহাদ্দিসিন আল্লামা আবুল বারাকাত বান্য়ানী আব্বাসী
রহমাতুল্লাহি আলাইহির নিকট হতে হাদীসশাস্ত্রীয় শিক্ষা লাভ করেন, তাঁর
তত্ত্বাবধানে থেকেই দাওরায়ে হাদীস (হাদীস শাস্ত্রের সর্বোচ্চ ডিগ্রি)
সম্পন্ন করেন। ৩৩ বছর বয়স পর্যন্ত দীর্ঘ চব্বিশ বছর শুধুমাত্র জ্ঞানার্জনেই
নিয়োজিত ছিলেন। এবং এ সময়ের মাঝে ৬০ টিরও অধিক বিষয় পরিপূর্ণরূপে রপ্ত করে
সেগুলোর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ পান্ডিত্য লাভ করেন। ২৫ বছর বয়সে তাঁকে সরকারীভাবে
আহ্মাদাবাদের মুফতী ঘোষণা করা হয়। হুযুরের একজন শিক্ষক ছিলেন, যার নাম ছিল
আল্লামা ইমাদুদ্দীন মুহাম্মাদ তারেমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি, যার কাছে তিনি
যুক্তিবিদ্যা সহ আরো কয়েকটি বিদ্যায় অধ্যয়নরত ছিলেন। এরই মাঝে একদিন
উস্তাদের ইন্তিকাল হয়ে যায়। উস্তাদের এই অসময়ে চলে যাওয়াতে হুযুর অত্যন্ত
মর্মাহত হন এবং নিজেকে একটি কামড়ায় আবদ্ধ করে নেন। সারাদিন কামড়ার ভেতরেই
অবস্থান করতেন শুধু নামাযের সময় মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করতেন, পরে আবার
কামড়ায় চলে আসতেন, সারাদিন এ কথা চিন্তা করতেন, “না জানি উস্তাদের নিকট হতে
কত কত বিষয়ে জ্ঞানার্জন করা এখনো বাকী রয়ে গেল”, এ চিন্তাটিই হুযুরকে গ্রাস
করে রেখেছিল এবং তাঁকে সর্বদা অবরুদ্ধ করে রাখতো, প্রশান্তির নিশ্বাসটি নিতে
দিত না। এমনিভাবে দিন রাত অতিবাহিত হচ্ছিল, একদিন আল্লাহর পেয়ারা হাবীব
সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর দীদার নসিব হয়ে যায়, নবীজির
হাত মুবারকে একটি কাগজের পৃষ্টা ছিল, যেটি নবীজী তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলেন এবং
ইরশাদ করলেন “এর মধ্যে ঐ সমস্ত বিষয়ের নাম আছে, যা তুমি এখনো অর্জন করোনি,
আজ আমি তোমাকে এ সমস্ত বিষয়ের শিক্ষা দান করলাম।“ শাহ ওয়াজীহুদ্দীন
রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইরশাদ করেন, “জ্ঞানার্জনের বিষয়ে এরপর থেকে আমাকে আর
কোন দিন দুশ্চিন্তার সম্মুখীন হতে হয়নি।“ কঠিন থেকে কঠিনতম যে কোন বিষয়
সমাধান করার জন্য যখন তাঁর সামনে পেশ করা হত, সামান্যতম দৃষ্টিপাত করেই
হুযুর সে বিষয়ে দ্রুত সমাধান প্রদান করে দিতেন।
মাদ্রাসায়ে আলিয়্যাহ আলাভিয়্যাহঃ- দীর্ঘ সময় ধরে অধ্যবসায়ের দ্বারা অর্জিত
ইল্মে দ্বীন মানবজাতি পর্যন্ত পৌছিয়ে দেয়ার মহান উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে
সুলতান বাহাদুর শাহ এর যুগে আহ্মাদাবাদের খানপুরে নিজ মালিকানাধীন যায়গাতেই
হুযুর নিজের মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপন করেন, মাদ্রাসাটি মাদ্রাসায়ে আলিয়্যাহ
আলাভিয়্যাহ নামে জ্ঞানপিপাসুদের মাঝে প্রসিদ্ধি লাভ করে, মাদ্রাসা নির্মাণ
হতে না হতেই জ্ঞানপিপাসুদের আনাগোনা আরম্ভ হয় , মাদ্রাসাটিতে প্রায়
প্রত্যেকটি বিষয়ে পাঠদান করা হত। তাফসীর, হাদীস, ফিক্হ, যুক্তিবিদ্যা,
দর্শন, গণিত ইত্যাদি ছাড়াও আরো অনেক বিষয় এর অন্তর্ভূক্ত। পার্থিব জ্ঞান
শিক্ষাদানের পাশাপাশি ছাত্রদেরকে আত্মন্নোয়ন এর চর্চা ও তাসাউউফ এর চর্চা
করানো হত। প্রাথমিক দিকে হুযুর নিজেই বেশির ভাগ বিষয়ের ক্লাস নিতেন, দিনের
বেলা ছাত্রদেরকে পাঠদান সত্বেও রাতের বেলা যিকির আযকার করার পর যদি সময়
সুযোগ পেতেন তবে রাতের বেলাও ছাত্রদেরকে জ্ঞানবিজ্ঞানের সূক্ষাতি সূক্ষ
বিষয়সমূহ সম্পর্কে অবহিত করতেন। ছাত্রদের ভাল মন্দের খোজ খবর নিতেন।
রূহানিয়্যাতের গুরুত্বপূর্ণ সবকসমূহ দ্বারা তাদের আত্মিক সমৃদ্ধি ঘটাতেন,
মৃত অন্তরকে জীবন দান করতেন। এ সমস্ত কারণে, দিন দিন মাদ্রসায়ে আলিয়্যাহ
আলাভিয়্যাহ এর খ্যাতি দ্রুততার সহিত চারিদিকে বিস্তার লাভ করতে লাগলো। অল্প
দিনের মাঝে দূর দূরান্ত থেকে জ্ঞানসন্ধানীরা এসে জড়ো হতে লাগলো। একটি বর্ণনা
মতে সুদূর লাহোর থেকেও কিছু সংখ্যক ছাত্র এখানে আসেন। ছাত্রদের পদচারণায়
“আলাভিয়্যাহ” নামক জ্ঞান বাগান মুখরিত হয়ে উঠলো। কালের পরিক্রমায় এটি একটি
মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আখ্যা পেল। ছাত্রসংখ্যা দ্রুততার সহিত
অধিকহারে বৃদ্ধি পাওয়াতে এবং ক্লাসের আধিক্যের কারণে হুযুরের
যোগ্যতাসম্পন্ন আওলাদগণ মাদরাসায় পাঠদানের কাজে নিয়োজিত হলেন। হুযুরের
জ্ঞানের অগাধ গভীরতা ও ছাত্রসমাজে ব্যাপকতার সহিত তাঁর প্রচার ও বিস্তারের
ফলস্বরূপ খুব অল্প বয়সেই তাঁকে “আলীয়ে সানী” “উস্তাযে উম্মাতে
মুহাম্মাদিয়্যাহ”, “উস্তাযুল আসাতিযাহ”, “উস্তাযুল বাশার”, “বে নযীর ফক্বীহ্",
“মালিকুল মুহাদ্দিসীন” এর ন্যায় সুমহান খেতাব সমূহ দ্বারা তৎকালীন উলামায়ে
কেরাম ভূষিত করেন। হুযুর কর্তৃক ছাত্রদের প্রতি প্রদত্ত সনদের সর্বমহলে
ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ছিল। এবং অচিরেই মাদ্রাসায়ে আলাভিয়্যাহ পাশ ছাত্রবৃন্দ
প্রতিটি যায়গায় ব্যাপকভাবে সমাদৃত হন এবং জনসাধারণের নিকট শ্রদ্ধার পাত্রে
পরিণত হন। শুধু হিন্দুস্তানের বুকেই নয় বরং, হারামাঈন শরীফাঈনেও তাদেরকে
যথাযথ মর্যাদা দান পূর্বক গ্রহণ করা হত এবং তাদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনাসমূহ হতে
ফায়দা হাসিল করা হত। দিন দিন হুযুর এর ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে এক
পর্যায়ে এটি আহ্মাদাবাদের বৃহত্তম ও প্রসিদ্ধতম মাদ্রাসায় পরিণত হয়। একটি
বর্ণনা মতে ছাত্র, সর্বমোট আশি হাজার ছাত্র তাঁর নিকট শিক্ষা লাভ করে ।
হুযুরের জীবদ্দশাতেই মাদ্রাসায়ে আলিয়্যাহ আলাভিয়্যাহ এর একাধিক শাখা খোলা
হয়, হুযুরের মাদ্রাসার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল এই যে, সেখানে শরী’আতে
মুহাম্মাদী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর চর্চা, পাশাপাশি
আত্মশুদ্ধির অনুশীলনও করানো হত। এ কারণেই ছাত্রগণ একই সময় আলিম ও সুফী হয়ে
মাদ্রাসা থেকে বিদায় নিতেন। শেষ বয়সে এসে এক পর্যায়ে হুযুর মাদ্রাসায়
পাঠদান থেকে অবসর গ্রহণ করতে চাইলেন। কেননা, হুযুর তাঁর জীবনের মহামূল্যবান
৬৪টি বছর মাদ্রাসার পাঠদানে ইতিপূর্বে ব্যয় করে ছিলেন। এহেন সিদ্ধান্ত নেয়া
মাত্রই কিছুদিন পর আল্লাহ্র পেয়ারা হাবীব সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
কর্তৃক সুসংবাদপ্রাপ্ত হন, নবীজি ইরশাদ করেন, “আমিও তোমার দর্স শোনার জন্য
আসি, তাই এটি ছেড়ে দিও না”। হাবীবে খোদা কর্তৃক নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে তিনি
আবার পাঠদানের কাজে মনোনিবেশ করেন, এবং আজীবন তিনি এ মহান কাজের সাথে
সম্পৃক্ত ছিলেন। নবীজির সাক্ষাৎ লাভের পর তিনি “দর্সে মুহাম্মাদী” নামে
তাঁর পাঠদান কর্মসূচীর নামকরণ করেন। “ইয়াদে আইয়্যাম” গ্রন্থের প্রণেতা
উল্লেখ করেন হযরত আল্লামা ওয়াজীহুদ্দীন গুজরাতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি সে সকল
উলামায়ে কিরামের অন্তর্ভূক্ত যাদের ঋণ হিন্দুস্তানবাসী কক্ষনো শোধ করতে
পারবেনা। হুযুরের শিক্ষকতা জীবনের এক অনন্য বৈশিষ্ট এও ছিল যে, যখন থেকে
তিনি শিক্ষকতা আরম্ভ করেন সেদিন হতে ইন্তকালের আগ পর্যন্ত তিনি মাত্র চার
বার বিশেষ কোন কারণবশতঃ কয়েকদিন পাঠদানে উপস্থিত হতে পারেননি।
বই পত্র রচনা ও ইল্মে দ্বীনের সেবাঃ- শায়খ ওয়াজীহুদ্দঈন আলাভী রহমাতুল্লাহি
আলাইহি নিয়মিত শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি অবসর সময়ে প্রচুর পরিমাণে
লেখালখি করতেন, মহান আল্লাহ তা’আলার বিশেষ কৃপায় ইল্মে দ্বীনের এমন কোন শাখা
নেই যেখানে হুযুর কলম ধরেননি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি প্রাচীন ও সহজে
অবোধগম্য বই গুলোর ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন নতুবা বই সমুহের ওপর টীকা
লিখেছেন, অনেক ক্ষেত্রে নিজেই বই রচনা করেছেন যেখানে ঘাটতি অনুভব করেছেন।
হুযুর শুধু মাত্র হাদীসশাস্ত্রের ওপর ৩২ টি রিসালাহ (ছোট আকারের বই) রচনা
করেছেন, হুযুর কর্তৃক রচিত সর্বপ্রথম বই “শার্হে ইরশাদ” । মাওলানা গুলাম আলী
আযাদ বিল্গ্রামী “মা’সারুল কিরাম” নামক গ্রন্থে হুযুর কর্তৃক রচিত বইয়ের
সংখ্যা ১৯৭ টি বলে উল্ল্যেখ করেছেন , আর “খুলাসাতুল ওয়াজীহ” গ্রন্থ প্রণেতা
এর নিকট এ সংখ্যা আরো বেশি, তাঁর রচিত কিছু প্রসিদ্ধ কিতাব এর মধ্যে
উল্ল্যেখযোগ্য হলো রিসালায়ে জান্নাতে আদ্ন আলা তাফসিরিল বায়যাভী, হাশিয়ায়ে
বায়যাভী, শার্হে নুখবাহ ফি উসুলিল হাদিস, হাশিয়ায়ে হিদায়াহ, হাশিয়ায়ে শার্হে
ভিকায়াহ, হাশিয়াহ আলা সার্হে আক্বায়িদে তাফতাযানী, হাশিয়াহ শিফায়ে ক্বাযী
আয়ায, শার্হে বাসীত ফিল ফারায়েয, হাশিয়াহ মুখতাসারু মা’আনী, শার্হে ওয়াজীয,
রিসালাহ আল কালাম, হাশিয়াহ আলা শার্হিল মাওয়াক্বিফ ফিল কালাম, হাশিয়াহ
শার্হে মাতালি’, হাশিয়ায়ে কাফিয়াহ ফিন্ নাহ্ভ্, হাশিয়াহ জালালিয়্যাহ,
ওয়াফিয়াহ শার্হে কাফিয়াহ, সার্হে আবয়াতে তাসহীল, হাশিয়াহ শার্হে ফাওয়ায়েদে
যিয়াইয়্যাহ, হাশিয়াহ যুব্দাহ, হাশিয়াহ শার্হে তাহ্যীব, শার্হে শামসিয়্যাহ
ফিল মানতিক, হাক্বীক্বাতে মুহাম্মাদী, রিসালাহ ঈমান, হাশিয়াহ বায্দাভী,
রিসালাহ ত্বারীকায়ে বাই’আত, আল মুখতাসারুল মাউলুদ লিল ঈমাম আল জাযারী,
আওরাদে ওয়াজীহাহ, মাক্তুবাত, ইত্যাদি সহ আরো শতাধিক গ্রন্থ, স্থান সংকুলান
না হওয়ায় সেগুলো উল্ল্যেখ করা সম্ভব হয় নি। বইপত্র রচনার পাশাপাশি
কাব্যচর্চার প্রতিও হুযুরের বিশেষ ঝোঁক ছিল।
মুজাদ্দেদিয়্যাত এর মর্যাদাঃ- সে যুগের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আলী
মুত্তাকী হিন্দী মদীনা শরীফে হাদীসের দর্স প্রদান করতেন। ঘটনাক্রমে একদিন
যখন এ হাদীস শরীফটি পড়াচ্ছিলেন যে, “আল্লাহ তা’আলা প্রতি শত বছরের মাথায়
একজন মুজাদ্দিদ প্রেরণ করেন, যিনি দ্বীনের মধ্যে সংস্কার করেন।“ হাদিসটি
শুনে ছাত্রদের মাঝে একটি চাঁপা আগ্রহ সৃষ্টি হল, তারা উস্তাদের নিকট জানতে
চাইলো, জিজ্ঞেস করলো “হুযুর, আমাদের বর্তমান যুগের মুজাদ্দিদ কে ?”
উস্তাদজ্বী জবাবে বললেন,” আমি এর উত্তর তোমাদেরকে আগামীকাল জানাবো।“ সে রাতে
শায়খ আলী মুত্তাকী তাহাজ্জুদের জন্য উঠলেন, তাহাজ্জুদ পড়ে নিজের প্রশ্নের
উত্তর জানতে চাইলেন, নবীয়ে পাক সাহিবে লাওলাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি
ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ থেকে জবাব আসলো “এ যুগের মুজাদ্দিদ ওয়াজীহুদ্দীন আলাভী”।
পরের দিন সকালে শায়খ আলী মুত্তাকী দর্স দেয়ার মাঝে ছাত্রদেরকে তাদের
প্রশ্নের জবাব সম্পর্কে অবহিত করলেন এবং সেটিই ছিল তাঁর শেষ দর্স, দ্রুত দর্স
শেষ করে শায়খ ওয়াজীহুদ্দীন আলাভীর খোঁজে বেড়িয়ে পড়লেন, তালাশ করতে করতে
হিন্দুস্তানের আহ্মাদাবাদে এসে উপস্থিত হলেন এবং শায়খ ওয়াজীহুদ্দীন আলাভী
রহমাতুল্লাহি আলাইহির সাথে সাক্ষাত করে সেখানেই রয়ে গেলেন।
বাই’আত, খিলাফাত ও ইজাযাতঃ- হযরত শাহ ওয়াজীহুদ্দীন আলাভী গুজরাতী
রহমাতুল্লাহি আলাইহি সর্বপ্রথম নিজ পিতা শাহ ক্বাযী নাসরুল্লাহ আলাভী
রহমাতুল্লাহি আলাইহির নিকট হতে চিশতিয়্যাহ এবং মাগরিবিয়্যাহ সিলসিলা হাসিল
করেন, এরপর মামাজান হযরত বাদ্রুদ্দীন উর্ফ শাহ বাড়া আবুল কাসিম সুহ্রাওয়ারদী
ও শায়খ নাজমুদ্দীন সিদ্দিকী সুহ্রাওয়ারদী রহমাতুল্লাহি আলাইহিমা এর নিকট
হতে সুহ্রাওয়ারদীয়্যাহ সিলসিলার সবক ও ওয়াযিফা লাভ করেন।
একটি বর্ণনানুসারে হযরত শায়খ মুহাম্মাদ গাওস গাওয়ালয়ারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
যখন গুজরাতের আহ্মাদাবাদে তাশরিফ আনেন, তখন হুযুরের মামা মাওলানা মুত্তাকী
সিদ্দিকী মতান্তরে মাওলানা য়াহ্য়া সিদ্দিকী রহমাতুল্লাহি আলাইহি হুযুরকে
শায়খ গাওয়ালয়ারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর সহিত সাক্ষাতের জন্য উৎসাহ প্রদান
করলেন, এবং হুযুরকে সাথে করে নিয়ে শায়খ গাওয়ালয়ারীর দরবারে হাযির হলেন,
হুযুর যখন শায়খ গাওয়ালয়ারীর মুখনিঃসৃত হাক্বিক্বাত মা’রিফাত সম্পর্কিত
প্রজ্ঞাপূর্ণ আলোচনা শুনলেন, তাঁর ভক্ত হয়ে গেলেন। সারারাত তাঁর খানক্বাহে
অবস্থান করলেন, এবং এর পর থেকে নিয়মিত শায়খের দরবারে আসা যাওয়া জ্বারী
রাখলেন, ফায়্য হাসিল করতে থাকলেন। একপর্যায়ে শায়খ গাওয়ালয়ারী হুযুরকে
সিলসিলায়ে শাত্ত্বারীয়্যাহ সহ সমস্ত সিলসিলার ইজাযাত ও যাবতীয় প্রকার সবক
প্রদান করলেন। একাকীত্বে বিশেষ কিছু নসীহত ও উপদেশমূলক কথা ইরশাদ করে শায়খ
গাওয়ালয়ারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি হুযুরকে স্বহস্তে ইজাযাত নামাহ লিখে প্রদান
করলেন।
নিজ মুর্শিদ সম্বন্ধে হুযুর “মালফুযাত” এ ইরশাদ করেন, “ যদি আমি গাউসুর
রহমান (শায়খ মুহাম্মাদ গাউস রহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর পদদ্বয় চুম্বন করার
সৌভাগ্য অর্জন না করতাম, তাহলে হাক্বীক্বাতের ভেদসমূহ আমার সামনে উন্মোচিত
হত না। খুবই অল্প সময়ের ভেতর শায়খের সুনজরের কারণে প্রথাগত বিশ্বাস এর
বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে সঠিক ঈমান এর বেহেশতে পদচারণা করার সুযোগ হল। আর যা
কিছু পাওয়ার বাকি ছিল তাঁর সমুদয়ই হাসিল হয়ে গেল। সারাটি জীবন আল্লাহ
তা’আলার যে খাস পরিচয় থেকে বঞ্চিত ছিলাম, শায়খের সান্ন্যিধ্যে এক রাত্রিতেই
তা নসীব হল।“
শাসক সমাজের সাথে হুযুরের সম্পর্কঃ- হুযুর তাঁর জীবদ্দশায় ১০-১২ জন বাদশাহর
উত্থান-পতন অবলোকন করেছেন, অধিকাংশ সুফিয়ায়ে কিরামের ন্যায় তিনিও বাদশাহর
শাহী দরবারে যাতায়াত পছন্দ করতেন না। তবে সমগ্র জীবদ্দশায় একবার তিনি
মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে বাদশাহর দরবারে উপস্থিত হন, এবং সেটি নিজের কোন
পার্থিব উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নয়, বরং ঘটনাটি এরূপ ছিল, যে একবার হুযুরের
খানকাহে এক বৃদ্ধ এসে উপস্থিত হলেন, বৃদ্ধের একটি মাত্র ছেলে ছিল, এবং
প্রশাসনের লোকজন তাকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করে তাঁর নামে মিথ্যা মামলা
দায়ের করে দেয়। বৃদ্ধটি হুযুরের খানকাহে এসে অঝর ধারায় কাঁদতে লাগলো, এবং
বলতে লাগলো, “হুযুর আমি শপথ করে বলতে পারি, আমার এ সন্তান নির্দোষ, সে কোন
অন্যায় করেনি, প্রয়োজনে আপনি বিষয়টি যাচাই করতে পারেন”, বৃদ্ধের এ করুণ
অবস্থা দেখে হুযুরের দয়া হল। তিনি জোড় আওয়াজে ইরশাদ করলেন, ওঠো, আমার সাথে
বাদশাহর দরবারে চলো, হুযুর বাদশাহ সুলতান মাহমুদের দরবারে পৌছালেন। যেমাত্র
বাদশাহ শুনতে পেলেন যে, তাঁর দরবারে উস্তাযুল উলামা শাহ ওয়াজীহুদ্দীন আলাভী
রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাশরীফ এনেছেন, কালবিলম্ব না করে তাঁর সাক্ষাতের
উদ্দেশ্যে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন, এমনকি শাহী মুকুটটিও পরিধান করার সময় পেলেন
না। দ্রুত শ্বাস ফেলতে ফেলতে হুযুরের সামনে হাতজোড় করে দাড়ালেন, বললেন,
“হুযুর, আপনি আমার দরবারে ? কি ব্যাপারে ? শুধুমাত্র হুকুম করুন।“ হুযুর
ইরশাদ করলেন, এ লোকটির ছেলে নির্দোষ, তাকে বিনা কারণে গ্রেফতার করে শাস্তি
দেয়া হচ্ছে, তাকে ছেড়ে দেয়া হোক। উত্তরে বাদশাহ বলেন, “হুযুর, আপনি বলছেন
যে সে নির্দোষ, তবে যদি তাঁর দোষ সাব্যস্তও হতো তাও আমি তাকে বেকসুর খালাস
করে দিতাম, কেনণা, আজ আপনি স্বয়ং আমার দরবারে পদদ্বয় রেখেছেন।“ হুযুরের যুগে
কোন রাজা বাদশাহ তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোন ধর্মীয় সিদ্ধান্ত বা কোন প্রকার
ফতোয়া জারির অনুমোদন দিতেন না।
সৃষ্টির প্রতি দয়াঃ- সুফিয়ায়ে কিরাম সর্বদা এ নীতি অবলম্বন করেছেন,” জীবে
সেবা করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর,” সেই একই চিত্র ছিল হুযুরের দরবারের,
যেখানে সর্বদাই নিঃস অসহায়দের ভীড় লেগে থাকতো, ঐতিহাসিক মুল্লা আব্দুল
কাদির বাদায়ুনী তাঁর “মুন্তাখাবুত তাওয়ারীখে” উল্লেখ করেন “ অসংখ্য মানুষ
যারা বিভিন্ন প্রকার সমস্যায় জর্জরিত এবং নানাবিধ মরণব্যাধি রোগে আক্রান্ত,
তারা হুযুরের দরবারে দু’আ নেয়ার জন্য আসতেন। হুযুর তাদের জন্য আল্লাহর
দরবারে ফরিয়াদ করলে আল্লাহ তা’আলা শীঘ্রই তাঁর দু’আ কবুল করে নিতেন। এ
ছাড়াও হুযুরের দরবারে যা হাদিয়া নয্রানা পেশ করা হত তিনি তার পুরোটাই
বঞ্চিতদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন, নিজের জন্য বা পরিবারের জন্য সেখান থেকে
কিছুই গ্রহণ করতেন না।
যুহ্দ ও তাক্বওয়াঃ- হুযুর শৈশব থেকেই শরীয়ত পালনের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী
ছিলেন। শরীয়তপরিপন্থী সকল কাজ হতে সর্বদা বেচে থাকতেন। ছাত্র বয়স থেকেই একটি
অনন্য অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন, যা পড়তেন সেটার ওপর অটল থেকে আমল করতেন। হালাল
ও হারামের মাঝে সর্বদা পার্থক্য করতেন হারামের নূন্যতম সন্দেহও যেখানে
সৃষ্টি হত সেখান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতেন। হারামকে কখনোই পাশে ঘিষতে দিতেন
না। কৈশোরের ঘটনা, একবার হুযুর হঠাৎ করে বাসার তৈরী খাবার আহার করা ছেড়ে
দিলেন, রোজা রাখতে আরম্ভ করলেন, অবিরাম রোজা রাখতে লাগলেন, এক মাস, দু মাস,
দেখতে দেখতে ৩ মাস বাসার খাবার খেলেন না, যখন প্রচন্ড ক্ষুধা অনুভব করতেন
তখন বনে চলে যেতেন, সেখান থেকে অল্প পরিমাণ গাছের লতাপাতা ও ফল আহার করে
আবার বাসায় চলে আসতেন। ক্ষুধার্ত পেটে সারাদিন অবিরাম অধ্যবসায় এর ফলে
হুযুরের স্বাস্থ্য দিন দিন লোপ পেতে লাগলো। এবং বিষয়টি হুযুরের বাবা শাহ
ক্বাযী নাসরুল্লাহ আলাভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর দৃষ্টিগোচর হয়, বাবা অগত্যা
হুযুরকে জিজ্ঞেস করলেন “আমি আপনাকে কিছুটা দূর্বল দেখতে পাচ্ছি” পরে খোজ
নিয়ে জানতে পারলেন যে তিনি প্রায় তিন মাস যাবৎ বাড়ির খাবার খাচ্ছেননা।
পূনর্বার বাবা জিজ্ঞেস করলেন “আপনি বাড়ির খাবার খাচ্ছেন না কেন ?” হুযুর
জবাব দিলেন, “আব্বাজান, বাড়ির খাবার আমার নিকট সন্দেহযুক্ত মনে হচ্ছে,” বাবা
জিজ্ঞেস করলেন “কেমন সন্দেহ ?” হুযুর জবাব দিলেন, “আব্বাজান, আপনি একজন
ক্বাযী (বিচারক), এবং আমার জানামতে, বাসার জন্য আপনি স্বয়ং বাজার করতে যাননা।
বরং, আপনার একজন কর্মচারী বাজারে যায়, যেহেতু আপনি নিজে বাজারে যাননা, তাই
আমার সন্দেহ হয়, আপনার ক্বাযী হওয়ার কারণে বিক্রেতারা আপনার কর্মচারীর কাছ
থেকে সদাইয়ের পরিপূর্ণ মূল্য নেয়না বা কোন মূল্যই নেয়না। এ কারণে, আমার
নিকট বাসার তৈরী খাবার পরিপূর্ণ হালাল মনে হয়না।“ ছেলের আপত্তি শুনে এবার
বাবা শাহ ক্বাযী নাসরুল্লাহ আলাভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে
উত্তর দিলেন,”আজ অবদি আমার বা আমার পরিবারের কোন সদস্যের পাকস্থলিতে এক
লোকমা পরিমাণও হারাম খাবার প্রবেশ করেনি।“ বাবার জবাব শুনে ছেলে পূনরায়
আপত্তি করলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “আব্বাজান, আপনি এতটা নিশ্চিত হয়ে কিভাবে এ
দাবী করছেন ?” জবাবে আব্বাজান ইরশাদ করলেন ”খাবারের প্রতি যদি সতর্কতার
সহিত যত্নশীল না হতাম এবং গুরূত্ব না দিতাম, তবে আল্লাহ তা’আলা কক্ষনো আমাকে
আপনার ন্যায় পুত্র দান করতেন না।“ জবাব শুনে হুযুর আশ্বস্ত হলেন এবং বাড়ীর
খাবার খাওয়া আরম্ভ করলেন। হুযুর অত্যন্ত সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন।
মাওলায়ে কায়েনাত শেরে খোদা আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু এর বংশধর হওয়া
স্বত্বেও জনসম্মুখে নিজেকে নবীবংশ বলে প্রকাশ করতেন না এবং বংশীয় গৌরব
করতেন না। দুনিয়াবাসীর কোন পরোয়াই করতেন না, জামা কাপড় পরিধানের ক্ষেত্রে
বিশেষ কোন পার্থক্য করতেন না । মোটা সোটা কাপড় পেলেও পরিধান করে নিতেন।
সমস্ত হাদিয়াহ ও নয্রানা অর্থ দান করে দিতেন।
ছাত্রবৃন্দ ও খলিফাগণঃ- হুযুর এর কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া ছাত্রের সংখ্যা আশি
হাজারের ও অধিক এবং অধিকাংশ ছাত্র হুযুরের খিলাফাত প্রাপ্তও ছিলেন। হুযুরের
ছাত্রবৃন্দ ও খলিফাগণের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল যে তাঁরা একই সাথে
উচ্চমানের আলিমও ছিলেন পাশাপাশি ওয়ালীয়ে কামিলও ছিলেন। তাদের মধ্যে
অধিকাংশই মুফতি, মুহাদ্দিস, ও ক্বাযীর পদে অধিষ্টিত ছিলেন, এবং সকলেই নিজ
নিজ পদে নজিরবিহীন ছিলেন। আলাভী বাগানের এই পূষ্পগুলো যেখানেই গিয়েছেন সৌরভ
ছড়িয়েছেন। যখনি কোন এলাকায় গিয়েছেন আলাভী জ্ঞানভান্ডার থেকে জ্ঞানের
মণিমুক্তা বন্টন করেছেন এবং উম্মাতের মাঝে ইল্মে মুস্তাফাভী নিঃস্বার্থে
বিলিয়েছেন। আলাভী এ বাগানের সৌরভ শুধুমাত্র হিন্দুস্তানের যমীনেই সীমাবদ্ধ
ছিলনা বরং তা আরব জাহানেও ছড়িয়ে পড়ে। হুযুরের শাগির্দগণের মাঝে যারা অধিকতর
খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, সিবগাতুল্লাহ মাদানী, ক্বাযী
জালাললুদ্দীন, মুল্লা হাসান ফারাগী, মুল্লা আব্দুর রহমান গুজরাতী, মীর
সাইয়িদ শাহ ইয়াসীন মুহাদ্দিসে দানিশমান্দ, মাওলানা শায়খ ফারীদ মুহাদ্দিস,
মাওলানা উসমান বিন ঈসা সিদ্দিকী, আল্লামা কামাল মুহাম্মাদ আব্বাসী, মাওলানা
শায়খ য়ুসুফ বাঙ্গালী, শাহ গাদা হুসাইনী, শাহ আলি মুত্তাকী রব্বানী, ক্বাযী
আব্দুল্লাহ, মাওলানা সাইয়িদ শাহ আব্দুল গফুর, মাওলানা আব্দুল গণী আব্বাসী,
মাওলানা সাইয়িদ আব্দুল আযীয, শাহ্ ঈসা মাদানী (রহমাতুল্লাহি আলাইহিম)
প্রমুখ।
অমূল্য বানীসমূহঃ-
**খোদায়ে কুদ্দুসকে সর্বদা স্মরন করো।**
**যিক্র এর দ্বারা ক্বল্ব থেকে ওয়াসওয়াসা দূরীভূত হয়, এবং অন্তরের পবিত্রতা
হাসিল হয়।**
**আল্লাহ তা’আলার স্মরন থেকে বিমুখ করে দেয় এমন অভ্যাসসমূহ থেকে বেচে থাকো।**
**অধিক হারে তেল আহার করো, মাংস অল্প পরিমাণে আহার করো।**
**বিশ্রাম গ্রহণের দ্বারা অলসতা অর্জিত হয়, তৃপ্তি নয়।**
**পৃথিবীকে বর্জন করো, তবেই আল্লহকে হাসিল করতে পারবে, এবং পৃথিবী থেকে দূরে
সড়ে যাও,
আল্লাহ তা’আলা তোমার নিকটবর্তী হবেন।**
**ইল্ম এবং তাসাউফ উভয়টিই হাসিল করো, কেননা উভয়টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
অভিন্ন।**
**যৌবনের ইবাদত অত্যন্ত উপকারী।**
**মুর্শিদের অনুমতি ব্যতীত কোন প্রকার সাধনা করা মানে কেবলমাত্র মস্তিষ্ককে
শুকিয়ে ফেলা বা
শরীরকে দূর্বল বানিয়ে ফেলার নামান্তর।**
**সেমা’ এর দ্বারা আত্মিক প্রশান্তি অর্জিত হয়।**
**নফ্স মানুষকে বিপদে ঠেলে দেয়। যিক্র করো, যাতে করে বিপদ হতে মুক্তি লাভ
করো।**
**নবীয়ে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর এর স্মরন দ্বারা
রুহানিয়্যাতও হাসিল হয় পাশাপাশি তাঁর নৈকট্যও লাভ হয়।**
**দূর্বলদের সাহায্য করিও, অভাবীদের দান করার দ্বারা হাতের ইবাদত আদায় হয়।**
**পরিবারবর্গ ও আত্মীয়াস্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করিও, উলামায়ে কিরাম এবং
আওলিয়ায়ে কেরামদের সাথে সাক্ষাৎ করলে পায়ের ইবাদত আদায় হয়।**
**আল্লাহ তা’আলার নিদর্শনসমূহ প্রত্যক্ষ করে অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি
হওয়ায় চোখ হতে অশ্রু প্রবাহিত হওয়া চোখের ইবাদত।**
**তাওহীদ (আল্লাহ তা’আলর একত্ববাদ) এর বাণী শোনা, উলামায়ে কিরাম ও আওলিয়ায়ে
কিরামের বাণী শোনা কানের ইবাদত।**
**দুনিয়ার মায়া থেকে অন্তরকে ছিন্ন করে আখিরাতের প্রতি মনোযোগী হওয়া
অন্তরের ইবাদত।**
**কুর’আন মাজীদ তিলাওয়াত ও অন্যান্য দুআ পাঠ করা জ্বিহবার ইবাদত।**
**আল্লাহ তা’আলার সাথে সাক্ষাতের আকাংখ্যা হওয়া রুহের ইবাদত।**
হাজীউল হারামাইন, সাইয়িদুস সাদাত মীর সাইয়িদ ইয়াসীন রহমাতুল্লাহি আলাইহির (হুযুরের
একনিষ্ঠ মুরীদ ও খলিফা) প্রতি হুযুরের নসীহতঃ- **কুর’আন মাজীদের তিলাওয়াত
সর্বদা করতে থাক। এবং যে বস্তুটি তোমাকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হওয়ার পথে
বাধা সৃষ্টি করে, তা থেকে বেচে থাক। রোজা রাখার চেয়ে তরিকতের সবক আদায়
দ্বারা অধিক রূহানী উন্নতি হাসিল হয়। মুর্শিদের সোহবতে থাকলে তাড়াতাড়ি
উন্নতি লাভ করা যায়। মুর্শিদের নজরের সামনে থাকা অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার।
একটি মাত্র নেক নজরের ইশারা হাজার হাজার লোকের অন্তর পরিবর্তন করে দেয়,
গুমরাহকে কামিল, এবং ফাসিককে ওলী বানিয়ে দেয়।**
**সালিকের জন্য সমীচিন হলো, সে যেন নিজের জবান ও পায়ের প্রতি লক্ষ্য রাখে,
এবং লোকজনের সাথে মেলামেশা না করে, এবং মানুষের বাসাবাড়িতে বেশী গমন না করে,
যতটুকু সম্ভব নিরব থাকে।**
**যিক্র বা সবক যেটুকুই পাঠ করো নিয়মিতভাবে পাঠ করো। কেনণা, নিয়মিত আদায়
করলে অল্প আমল দ্বারাও ফায়দা হাসিল করা যায়। কোন পাথরের ওপর যদি এক দিরহাম
পরিমাণ এলাচ এর দানা ফেলা হয়, তাতে পাথরের কোন পরিবর্তন হবে না, তবে পানির
একটি ফোটা যদি সর্বদা পাথরের ওপর পড়তে থাকে তবে তা পাথরকে ছিদ্র করে ফেলে।**
**যখন মসজিদে প্রবেশ করো তখন, “ইগফিরলি বিহাক্কি মুহাম্মাদ” পাঠ করো, গুনাহ
মাফ করে দেয়া হবে।**
**যে কোন মনোবাসনা পূরণের জন্য “আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাযি লা ইলাহা ইল্লা
হুয়াল হাইয়ুল কাইয়ুমু ওয়া আতুবু ইলাইহি” ১৬০৮ বার পাঠ করো।**
সফরে আখিরাতঃ- হুযুর শেষ জীবনে অত্যন্ত দূর্বল হয়ে পড়েন, তাই শুধুমাত্র
হাদিস শরীফের ক্লাস নিতেন, অন্য সব বিষয় হতে অব্যাহতি নেন। হুযুরের
ইন্তিকালের বছর আহ্মাদাবাদে সুপেয় পানির চরম সংকট দেখা দেয়, কোথাও পান করার
মত পানি পাওয়া যাচ্ছিলনা, লোকজন হুযুরের দরবার শরীফে জড়ো হয়ে পানির তীব্র
সংকটের কথা হুযুরকে জানালেন, এ সময়ে হুযুরের হাত মুবারকে একটি লাঠি ছিল ,
লাঠির মাথা দ্বারা হুযুর যমিনের ওপর সজোরে আঘাত করলেন, এতে করে যমীনে প্রায়
দু ফুট পরিমাণ গর্ত হয়ে সেখান থেকে আল্লাহ তা’আলার কৃপায় জলধারা বেড়িয়ে আসে
যা আজও হুযুরের মাযার শরীফের পাশে অবস্থিত রয়েছে, যে পানি পান করলে
তৃষ্ণার্তের তৃষ্ণা নিবাড়িত হয় এবং অসুস্থ ব্যক্তি রোগব্যাধি থেকে আরোগ্য
লাভ করে।
৯৯৭ মতান্তরে ৯৯৮ হিজরীর ২৯ ই মুহাররাম, রবিবার দিন সুব্হে সাদিকের সময় ছিল,
প্রেমময় মা’বুদের ডাকে সাড়া দিয়ে ৮৮ বছর বয়সে শাহ ওয়াজিহুদ্দীন আলাভী
গুজরাতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ অস্থায়ী পৃথিবী ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি
ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন, ইন্তিকালের খবর জানাজানি হতেই গোটা আহ্মাদাবাদে
শোকের ছায়া নেমে আসে, কি গরীব কি ধনী , কি হিন্দু কি মুসলিম, ইন্তিকালের
খবর জানা মাত্রই সকলে শোকে শোকাতুর হয়ে পড়ে পুরো শহর শোকে নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
হুযুরের ইন্তিকাল এর পর এ কথার সত্যায়ন হয় “মাউতুল আলিমি মাউতুল আলাম” একজন
আলিমের মৃত্যু মানে গোটা জগতের মৃত্যু। হুযুরের জানাযায় গোটা শহর শামিল হয়
এবং জানাযার পর লোকেরা মাথায় মাথায় খাটিয়া মুবারক নিয়ে বহন করেন এবং
খানক্বাহ শরীফের আঙিনায় দাফন করা হয়। পরবর্তীতে সেখানে হুযুরের একনিষ্ঠ
মুরীদ নাওয়াব মুর্তাযা খাঁ খানপুরী এক আলিশান মাযার নির্মাণ করেন, যেখানে
আজও শত শত লোক যিয়ারতের উদ্দেশ্যে উপস্থিত হন। হুযুরের বাৎসরিক উর্স মুবারক
প্রতি বছর ২৯ মুহাররাম যথাযথ মর্যাদার সহিত উদযাপিত হয়ে আসছে,
আলহামদুলিল্লাহ।
জগতে যে পর্যন্ত ইল্মে দ্বীন এর চর্চা থাকবে ততদিন পর্যন্ত শাহ
ওয়াজীহুদ্দীন আলাভী শাত্ত্বারি রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর নাম মুবারক সম্মান ও
মর্যাদার সহিত স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর পবিত্র স্বত্ত্বার মাধ্যমে মানবজাতি
ইলমে দ্বীনের যে মহান নিয়ামত পেয়েছে তা ভুলে যাবার নয়।
মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে প্রার্থনা করি, তিনি যেন শাহ্ সাইয়িদ আহ্মাদ
ওয়াজীহুদ্দীন আলাভী আল হুসাইনী গুজরাতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর ওয়াসিলায় এবং
তাঁর চিরস্মরণীয় খিদমাতের ওয়াসিলায় আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা নসীব
করেন এবং সত্য ও নাজাতদানকারী জ্ঞান অর্জন করার তাওফিক দান করেন। আমিন।
**ফাতিহা শরীফ পাঠ করে হুযুরের রূহ মুবারকে ইসালে সাওয়াব করার অনুরোধ রইলো।

Mazar of Shah Wajihuddin Alvi Gujarati (ra) at
Ahmadabad city of Gujarat , India

Written By Syed Arbaz Shahbazi |
|
This site is
dedicated to Dr. Syed Khalilullah
A wonderful man who believed in the future of Shahbaz Center and donated it's land.
|
|